Wednesday, March 28, 2012

চিংড়ি ফুল

বেশ কয়েক মাস আগে আমাকে রেডউড ট্রির খবরটি জানিয়েছিলেন বৃক্ষপ্রেমিক আমাতুল আজিজ। তখন আগাম বলে রেখেছিলেন, এই গাছের ফুল ফুটলে আমাকে খোঁজ জানাবেন। যথারীতি ফুল ফোটার খবর জানিয়েছিলেন। তাঁর লালমাটিয়ার বাসায় গিয়ে বেশ কিছু ফুলের পাশে পাওয়া গেল এই ফুল। গাঢ়-গোলাপি রঙের ফুলগুলোর পাপড়ি যেন পাখির পালক। দূর থেকে বাগানবিলাসও মনে হতে পারে। গাছটি তাঁর বোন চট্টগ্রামের একটি নার্সারি থেকে এনে দেন। ফুল বেশ চেনা মনে হলেও সঠিক শনাক্তকরণের জন্য অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার শরণাপন্ন হলাম। তিনি জানালেন, গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Justicia brandegeeana (Syn. Beloperone guttata)। প্রচলিত কোনো বাংলা নাম নেই। কারণ, এটি আমাদের প্রাকৃতিক গাছ নয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘এটি আলংকারিক বৃক্ষ হিসেবেই অনেকে ঘরের বারান্দায় কিংবা একচিলতে বাগানে চাষ করছেন। এই গাছ আমাদের দেশে এসেছে অতি সম্প্রতি।’ এদের আদি আবাস মেক্সিকো, গুয়েতেমালা ও হন্ডুরাস। ইংরেজি নাম Maxican Shrimp Plant বা Shrimp Plant, অর্থ চিংড়ি গাছ। ফুলের গড়ন চিংড়ি মাছের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় সম্ভবত এমন নামকরণ। সারা পৃথিবীতে এদের অনেক আবাদিত জাত দেখা যায়। তাতে বর্ণবৈচিত্র্যও অঢেল।
গুল্মশ্রেণীর গাছ। শাখাগুলো ছড়ানো ধরনের। ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কাণ্ড কাষ্ঠল ও দাগবিশিষ্ট। পাতা ডিম্বাকৃতির, দুই থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার হতে পারে। পত্রবৃন্ত আকস্মিকভাবে ক্রম সূক্ষ্ম থেকে সরু, গাঢ় সবুজ রঙের, উভয় পিঠই রোমশ, শিরা ছয় থেকে সাত জোড়া। মঞ্জরিপত্র ডিম্বাকৃতির, প্রায় দেড় সেন্টিমিটার সাদা রোমযুক্ত গোলাপি লাল রঙের। বৃত্যাংশ পাঁচটি, ছয় মিলিমিটার লম্বা, নিম্নাংশে যুক্ত, হালকা সবুজাভ-সাদাটে। পুংকেশর দুটি, দেড় সেন্টিমিটার লম্বা, নলাকার ও সাদা, ভেতরের দিকে বিন্দুর মতো রক্তাভ বর্ণের, ওপরে দ্বিখণ্ডিত, নিচে ত্রিখণ্ডিত; ভেতর এবং বাইরের পিঠ রোমশ।
জন্মস্থানে ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি হলেও আমাদের দেশে বর্ষা থেকে হেমন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ফুল পাখি ও প্রজাপতিদের আকৃষ্ট করে। বংশবৃদ্ধি কন্দ ও বীজে। সাধারণত টবেই চাষ।
প্রথম আলো|মোকারম হোসেন|তারিখ: ১৩-০৩-২০১২

রুদ্রপলাশ


আফ্রিকান টিউলিপ ইংরেজি নাম। বাংলা নাম রুদ্রপলাশ। নামটি কবিগুরুর দেওয়া।
রমনা পার্কে প্রথম পরিচয়। তারপর দেখা হয় বলধা গার্ডেনে। সেই থেকে রুদ্রপলাশের ছবি তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা। রমনা পার্কের রুদ্রপলাশের দিকে ঘাড় উঁচু করে দৃষ্টি প্রসারিত করলেও ফুলের দেখা মেলা ভার! কেবল একটা-দুটো ফুল, গাছ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়লে তবে দেখা মেলে। কিন্তু সে ফুলের ছবি তো আর তোলা যায় না! সে জন্যই এত দিন রুদ্রপলাশের ছবি তোলা হয়ে ওঠেনি।
এর মধ্যে বলধা গার্ডেনের গাছটি বয়সের ভারে আর ঝড়ের আঘাতে ভেঙে পড়লে শেষ হয় গাছটির শতবর্ষের ইতিহাস। রুদ্রপলাশের ছবি না তোলার আফসোসটা তাই থেকেই গিয়েছিল।
এখন বসন্ত। ক্যামেরার প্রতি তাই ফুলের সহজ হাতছানি। একদিন ধানমন্ডির রাস্তায় রিকশায় ঘুরে ঘুরে বসন্ত ফুলের সমাহার দেখছিলাম। ভাষাসৈনিক তোয়াহা সড়কের পাশে একটি কমিউনিটি সেন্টারের উল্টা দিকে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। রুদ্রপলাশ! ছোট্ট আকারের গাছ ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে, ফুল একেবারে হাতের নাগালে। ক্যামেরা তাক করে ফটাফট ছবি তোলা শুরু। পথচারীদের প্রশ্নবাণ, ‘ভাই, এটা কী ফুল!’ ক্লান্তিহীন বলে যাই, রুদ্রপলাশ! এর মধ্যে পথশিশুরা এসে রাস্তায় পড়ে থাকা কলি তুলে মাথা ভেঙে টিপে একে অপরকে পিচকারির মতো করে পানি ছিটিয়ে দিল। আমিও পরীক্ষায় নামলাম। মজার দৃশ্য বটে! প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা জানালেন, ফুল যেভাবে মধু সংরক্ষণ করে, ঠিক তেমনি রুদ্রপলাশের কলি পানি ধরে রাখে। এই পানি সুস্বাদু, মিষ্টিও। তবে সেই পানি আমার আর পান করে দেখা হয়নি। আপনি আগ্রহী? যেতে হবে রমনা উদ্যানে, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা ধানমন্ডির (৯/এ) ভাষাসৈনিক তোয়াহা সড়কে।
রুদ্রপলাশের বৈজ্ঞানিক নাম Spathodea campanulata। এরা Bignoniaceae পরিবারের সদস্য। ১৫ থেকে ২০ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন একটি চিরসবুজ গাছ। কোথাও কোথাও এর বেশি উচ্চতার রুদ্রপলাশের দেখা মেলে। বসন্তের শুরুতে উজ্জ্বল সবুজ পাতার রুদ্রপলাশ গাছের ডালে ডালে থোকায় থোকায় লাল রঙের ফুল ফোটে। কোথাও কোথাও হলুদ রঙের রুদ্রপলাশেরও দেখা পাওয়া যায়। এই প্রজাতির রুদ্রপলাশকে বলা হয় Lutea। আদি নিবাস আফ্রিকা অঞ্চলে, তাই নাম আফ্রিকান টিউলিপ।
প্রথম আলো|ফারুখ আহমেদ | তারিখ: ২১-০৩-২০১২

চেরি ফুল


এই বসন্তে চেরি ফুল ফুটেছে ঢাকায়! বছর খানেক আগে সরাসরি জাপান থেকে নিয়ে আসা গাছ থেকে কয়েক দিন আগে নজরকাড়া ফুল ফুটেছে বৃক্ষপ্রেমী হাবিবা জাভেদের বাসায়। তাঁর উত্তরার বাসায় গিয়ে চেরি ফুলের রাজসিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই। ফুলের এমন স্নিগ্ধ শোভা দেখে অনুভব করেছি, জাপানিরা কেন চেরি ফোটার দিনে উৎসব করে! দারুণ এক সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে চেরি ফুলের। জানামতে, এর আগে আমাদের দেশে সত্যিকার চেরি ফুলের কোনো গাছও দেখা যায়নি।
হাবিবা জাভেদের এই ছাদের বাগানে আরেকটি গাছেও চেরি ফুল ফুটেছিল কয়েক দিনের জন্য। তিনি আরও কয়েকটি চেরি ফুলের গাছ লাগিয়েছেন তাঁদের গ্রামের বাগানে। তাঁর ছাদের বাগানে প্রায় ৪০০ জাতের বনসাই রয়েছে, যার অধিকাংশই অপ্রচলিত ধরনের গাছ থেকে তৈরি। সচরাচর কেউ করেন না—এমন গাছপালার বনসাই করাই তাঁর শখ। এরই ধারাবাহিকতায় চেরি ফুলের বনসাই বানানোর কাজ শুরু করেন তিনি।
ফুল-ফল মিলিয়ে সারা পৃথিবীতে অসংখ্য জাতের চেরি পাওয়া যায়। শুধু পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলেই সংখ্যাটি প্রায় ৪৫০। ব্যাপকতার কারণে এই গণে গুল্ম থেকে শুরু করে উঁচু বৃক্ষও রয়েছে। তবে গাছ সর্বোচ্চ ৩০ মিটারের মতো উঁচু হতে পারে। সেই সঙ্গে ফুলের অসংখ্য রকমফেরও চোখধাঁধানো। মূলত ফুল, ফল ও আলংকারিক শোভাই এই গাছের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। এরা পিচ ও এপ্রিকট ফলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। জাপানে চেরি ফুলের স্থানীয় নাম ‘সাকুরা’ (জাকুরা)। প্রজাতিভেদে চিরসবুজ ও পত্রমোচি—দুই ধরনের গাছ দেখা যায়। Prunus cerasoides জাতের গাছ হিমালয় অঞ্চলের বুনো চেরি হিসেবেই পরিচিত। চীন, মিয়ানমার ও ভারতে এই জাতের গাছ সহজলভ্য।
চেরি (Prunus spp) গাছের কাণ্ড অসমান, ডালপালা বিক্ষিপ্ত ও নোয়ানো স্বভাবের। পাতা সবুজ, লম্ব আয়তকার, ১০ সেন্টিমিটার বা ততোধিক অথবা বিচিত্র গড়নের, কিছু জাতের পাতা দেখতে অনেকটা পাটপাতার মতো, শিরা স্পষ্ট, কিনারা দাঁতানো, কোনো কোনোটি বিপ্রতীপভাবে বিন্যস্ত। প্রস্ফুটন মৌসুমে অনেকটাই পত্রহীন। গুচ্ছবদ্ধ ফুলগুলো প্রধানত গোলাপি, সাদা ও লালচে। পাপড়ি ও ফুলের গড়ন বিচিত্র। অসমান পাপড়িসংখ্যা সাধারণত পাঁচ, মাঝখানে সোনালি একগুচ্ছ মুক্ত পুংকেশর। সারা বিশ্বে এদের কিছু জাত ফুল ও কিছু জাত ফলের জন্য বিখ্যাত।
জাপানে মার্চের শেষ ভাগ থেকে এপ্রিলজুড়ে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী চেরি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। চেরি ফুলকে বরণ করে নেওয়ার এই অনুষ্ঠানের স্থানীয় নাম ‘হানামি’। ধারণা করা হয়, ৭১০ সাল থেকে জাপানে চেরি উৎসব শুরু হয়েছে।
আমাদের দেশে অনেকেই ‘ক্রেব’ বা ‘ফুরুস’ (Lagerstroemia indica) ফুলকে ভুলবশত চেরি ফুল নামে ডাকে। আদতে চেরি ফুলের সঙ্গে এই গাছের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রথম আলো|মোকারম হোসেন|তারিখ: ২০-০৩-২০১২

Tuesday, March 27, 2012

নোংমাংখা


‘রেড নোংমাংখা’ ফুলটির ইংরেজি নাম। বাংলা নাম নেই। ফুলের কোনো সুবাস নেই, তবে দেখতে আকর্ষণীয়। গাছ চিরসবুজ। উপরিভাগের তীক্ষ ফলার ওপর ইট-লাল চোঙাকৃতির ফুল ফোটে বসন্তকালে। দেখতে অনেকটা বাসক ফুলের মতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বাগানে পাশাপাশি দুটি গাছ দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় সবুজ পাতার অগ্রভাগ বর্শার মতো সুচালো।
ডুলিচাঁপা গাছে ফুল এল কি না, তা দেখার জন্য কার্জন হলের উদ্ভিদবিদ্যার বাগানে গেলে এই ফুলের সঙ্গে দেখা। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক মোহাম্মদ জসিমউদ্দিনের শরণাপন্ন হলাম। তাঁকে ফোন করে ফুলের বিবরণ জানাতেই তিনি নাম বলে দেন। দাঁতভাঙা সেই নাম শুনে বাংলা নামের তাগিদ অনুভব করি। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার শরণ নিলাম। আমাদের দেশের বেশির ভাগ বিদেশি ফুলের বাংলা নাম না থাকায় তাঁর কণ্ঠেও আক্ষেপ ঝরে।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মণিপুরে নোংমাংখার মণিপুরি নাম হচ্ছে ‘নোঙমাঙখা অঙাঙভা’। ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও এই ফুলের নিজস্ব একটি নাম আছে। এই ফুলের উদ্ভিদবিজ্ঞানীয় নাম হচ্ছে Phlogacanthus pubinervius। এটি Acanthaceae পরিবারের সদস্য।
প্রথম আলো| ফারুখ আহমেদ|তারিখ: ২৮-০৩-২০১২